সাহিত্যে মানব সময় ||
পাগলীর মুখের দিকে তাকিয়ে সারা আর জিমি এবার বিস্মিত। তারা সমস্বরে ‘ওয়াও’ শব্দ করে নিজেদের মাঝে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো এবং কিছুটা পিছু হটে এলো। বিস্মিত মমিনও। তার কপালও কুচকে আছে কিছুটা। কিন্তু অরু একটুও নড়লো না। গভীর, নিস্পলক চোখে সে তাকিয়ে ছিলো পাগলীর মুখের দিকে।
বিমূঢ় দৃষ্টিতে পাগলিও বুঝি অরুকে দেখলো খানিক, তারপর আড়মোড়া দিয়ে উঠে খপ করে পানির বোতলটা কেড়ে নিয়ে ছুটে চলে গেলো সামনে।
পাগলী দৌড়াচ্ছিলো আলুথালু পায়ে। তার গায়ে একটা ছেড়া, লম্বা, ঢোলা পোশাক। কিন্তু কিছুদূর যেতেই ছেলেমেয়েগুলো আবারও তার পিছু নিলো। আস্তে আস্তে তাদের দলটা দূর থেকে আরও দূরে চলে যেতে যেতে অদৃশ্য হলো।
অরুদের গাড়িটা এখন শহরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আরোহীরা এখন কেউ কোনো কথা বলছে না। অরু এবারও পেছনের সিটে, জিমি আর সারার মাঝখানে বসলো। তার চোখগুলো স্থির, মুখটা থমথম করছে। পাশের দুজনও চুপচাপ। অরু কেমন ঘোরলাগা গলায় বলল
– গাইজ, আর ইউ থিঙ্কিং হোয়াট আ’ম থিঙ্কিং ?
দুপাশের দুজনই গম্ভীর, সমস্বরে বলল
– হুম..
– হোয়াট ইজ ইট..?
একটু নীরবতা। সারা গম্ভীর গলায় বলল
– ইয়ে মানে… তোকে… দেখতে……. একদম ওই পাগলীটার মতো..!
আরও একটু নীরবতা। তারপর দুপাশের দুজনই খিলখিল হাসিতে লুটিয়ে পড়লো।
অরু এই কৌতুকে কেন যেন হাসতে পারলো না। সে তখনও স্থির ও গম্ভীর।
– স্টুপিড। ইউ নো… পৃথিবীতে একই রকম দেখতে দু’জন করে মানুষ আছে, আমার বাবা বলেছে। ইউ বেটার নো, আমার বাবা কখনই মিথ্যে বলে না।
সারা আর জিমি হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। সারা বলল
– দ্যাট ওয়াজ ভেরি ইন্টারেস্টিং। বাট, একেবারে তোর মতন দেখতে একটা পাগলী, ব্যাপারটা ফানি, না…? হি হি হি…
জিমি বলল
– ডুড সিরিয়াসলি, তোদের দু’জনার চিবুকের তিলটা কিন্তু একদম পারফেক্টলি পয়েন্টেড। হাউ ইজ ইট পসিবল? আর কার্লি হেয়ার? আই থিঙ্ক, তুই ভ্রু প্লাক না করলে তোর ভ্রু গুলোও অমনই হতো, হাউ স্ট্রেঞ্জ…! একটা রাস্তার পাগলীর সাথে আরাধ্যা চৌধুরীর চেহারার হুবহু মিল…?
গাড়িটা থেমেছিলো সারাদের গেটে। সারা নেমে বিদায় নিয়েছিলো। উঁকি দেয়ে অরুকে বলে গেলো
– ইট ওয়াজ অল বাট ফান ডার্লিং, ডোন্ট মাইন্ড। আই’ল কল ইউ… বাই…
আর একটু এগিয়ে জিমিও কি কি যেন বলে নেমে গেলো।
মিউজিক প্লেয়ারে বেয়া মিলার গাইছে। গাড়িতে হাই ভলিউম মিউজিক শোনা অভ্যেস অরুর, মমিন জানে। বাকিটা পথ একা একা অরুর যেন খারাপ না লাগে, অভিজ্ঞ মমিনের খেয়াল আছে সেদিকে। অরু তখন চোখ বন্ধ করে ভাবছিলো অন্যকিছু। তার বন্ধ চোখের পাতায় অবিকল তার মত দেখতে মধ্যবয়সী এক পাগলীনী। একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকা তাদের দু’ একটা মিনিট।
একটু আগে তার জীবনে এই চরম বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটে গেছে। অবিকল তার মত দেখতে একটা মানুষ এবং তারা দুজনেই মুখোমুখি। একে অপরের চোখে চোখ রেখে কিছুটা সময়। আচ্ছা অরুর কী ওকে একটুখানি ছুঁয়ে দেখা উচিত ছিলো?
কী অদ্ভূত! একই রকম দেখতে তারা দু’টি মানুষ, কেমন হত সে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি?
গাড়ির হর্ণে চোখ খুলল অরু। বিশাল বাগানের মাঝখান দিয়ে গাড়িটা ঢুকলো। দোতালার খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে তার মা, রুবিনা চৌধুরী। তার মুখ হাসিহাসি। অরু গাড়ি থেকে নেমে হাত নাড়লো মায়ের দিকে। মেয়েকে ধরতেই বুঝি রুবিনা ভেতরে চলে গেলো। অরুও দৌড়ে চলে গেলো বাড়ির ভেতরে।
অরুদের বাড়িটা দুই তরফের। তানভীর চৌধুরর বড় ভাই এনামুল চৌধুরীও তার পরিবার নিয়ে থাকেন এখানে। এনামুলের এক ছেলে এক মেয়ে, তারা অরুর বয়োজৈষ্ঠ। এনামুলের স্ত্রী, তমাকে অরু বড় আম্মু সম্বোধন করে।
অরুর এ বাড়িতে এক রাতের অনুপস্থিতি এবং সকাল বেলার এই প্রত্যাবর্তন পুরো পরিবারের জন্য যেন এক বিশাল ঘটনা। বাড়ির ভেতরে, উঠোনের খোলা চত্বরে অরুকে দেখতে সবাই জটলা করেছে। অরু একে একে সবার প্রশ্নের জবাব ও এক রাতে তাদের জমা হওয়া আদরের ভারে আপাতত দিশেহারা। এক রাতের অনিয়মে, তার শরীরে কী কী ক্ষতি হয়ে গেছে তাই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে আর বলাবলি করছে সবাই। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে যে কাজটা এখন তাকে করতে হবে তা হলো, বাবাকে ফোন করে তার ফেরার খবরটা জানাতে হবে।
ফোন ইতিমধ্যে চলে এসেছে। তার ডাক পড়লো ভেতর বাড়ি। অরু দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো। সেখানে রিসিভার হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো মা। অরু প্রায় কেড়ে নিলো রিসিভার। আহ্লাদী গলায় বলল
– হ্যালো পাপা…
– হ্যালো মাই সুইটহার্ট… মাই বেবি…মাই জান…
– পাপা, তুমি কখন ফিরবে?
– আজ অনেক রাত হবে মাম্মা…। গতরাতে তোমার ঘুম হয়েছিলো? খুব হৈচৈ করেছো তাই না?। সো, নাউ ইউ নিড এ লং স্লিপ…।
– ওহ নো পাপা, আ’ম এবসিলিউটলি ফাইন
– নো নো ডিয়ার। আমি যেন শুনি, তুমি এখন ফ্রেশ হয়ে একটা লম্বা ঘুম দিয়েছো। আর কোন কথা শুনতে চাই না। গিভ মি এ হাম্ব এন্ড গো…
অরু অপ্রসন্ন মুখে তার পাপাকে হাম্ব দিলো এবং ফোন রেখে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেলো।
অরু শাওয়ার নিলো। মিউজিক প্লেয়ারে এ্যালেন ওয়াকার চলছে। মোটা টাওয়েল জড়িয়ে নিজের বিলাসবহুল ঘরের আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ নিজেকে দেখলো। মুখটা আয়নার কাছাকাছি এনে হঠাৎ তার চোখদুটো স্থির হয়ে গেলো। নিশ্চল চোখে নিজের আঙুল দিয়ে চিবুকের তিলটা স্পর্শ করলো। বিস্ময়ভরা চোখে নিজেকে দেখলো খুটিয়ে খুটিয়ে। মনে মনে চলল তুলনা, এক উন্মাদিনী মধ্যবয়সীনী, যার চিবুকে ঠিক এমনিই একটা তিল, কার্লি হেয়ার, চিকন জোড়া ভ্রু… এমন কি ঠোঁটগুলোও…
পারদিন সকালে নাশতার টেবিলে অরু বসেছিলো তার বাবা মার সাথে । পাপার সাথে কাল দেখা হয়নি তার। গভীর রাতে ফিরে অরুর ঘরে গিয়েছিলো তানভীর। মেয়ের কপালে আদর দিয়ে , হিম শীতল ঘরের এসিটা খানিক কমিয়ে দিয়ে, অরুর গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিয়ে এসেছিলো। এটা সে প্রায় প্রতি রাতেই করে।
খাবার টেবিলে টুকটাক কথা হলো তাদের। তবে অরুকে কেমন অন্যমনষ্ক লাগছিলো। সে খাবারে তেমন মনোযোগী ছিলো না। রুবিনা তাড়া দিলো
– কী হলো, ঠিকমতো খাও….
তানভীর খেয়াল করলো, বলল
– একটা রাতের অনিয়ম তোমাকে এক সপ্তাহ ভোগাবে, দেখো…
অরু বিরক্ত মুখে বলল
– পাপা, আমি একদম ঠিক আছি।
অরু খানিকটা খাবার মুখে দিয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
– আচ্ছা মম্ , আমি কার মতো দেখতে হয়েছি?
রুবিনা বলল
– মানে…?
– মানে, সবাইতো পরিবারের কোরো না কারো মতো দেখতে হয়…। তুমিইতো বলো, সুহা আপু ওর বাবার মতো দেখতে, সাকি ভাইয়া বড় আম্মুর মত দেখতে…। সো, আমিও নিশ্চই কারো না কারো মতো দেখতে হয়েছি…তাই না?
হো হো করে হেসে উঠলো তানভীর, বলল
– ও এই কথা…? দেখো ব্যাপারটা তো সম্পূর্ণ জেনেটিক। বাচ্চা যে সবসময় তার বাবা বা মায়ের মতই দেখতে হবে এমন কিন্তু নয়।
– আমি ওসব জানি পাপা। কিন্তু আমি তো কারো না কারো মত নিশ্চই হয়েছি…?
রুবিনা বলল
– তুমি যে আমাদের দুজনার মত দেখতে হওনি, আমরা তাতে একপ্রকার খুশিই হয়েছি। তোমার পাপা আর আমি কেমন শ্যামবর্ণ দেখেছো? আর তুমিতো আমাদের মাশাআল্লাহ, একটা পরী বাচ্চা।
অরু তাও প্রসন্ন হলো না। খেয়াল করলো তানভীর। মুখে খাবার দিয়ে সে অনেক ভেবে বলল
– আমার এক ফুপু ছিলো, অসম্ভব সুন্দরী। আমরা ছোটবেলায় তাকে দেখেছি। আমার ধারণা তুমি কিছুটা তার মতো দেখতে হয়েছো।
অরু উৎসাহী গলায় বলল
– কোথায় থাকেন তিনি? ওনার কী আমার মত চিবুকে তিল ছিলো?
তানভীর চিন্তিত গলায় বলল
– না, তোমার মত চিবুকে তিল ছিলো না। আর উনি মারা গেছেন বহু বছর আগে।
অরু হতাশ হলো। তানভীর বলল
– তুমি খাচ্ছো না অরু। প্লেট শেষ করে উঠবে।
তানভীর উঠে গেলো।
অরু কাতর চোখে মায়ের দিকে তাকালো। রুবিনা অরুর প্লেটে আরও খানিকটা খাবার তুলে দিয়ে কড়া চোখে খেতে ইঙ্গিত করলো। অরু বিস্ময়ে, বিরক্ত। সে বলল
– দেশের বাইরে গিয়ে তোমাদের এই অত্যাচারের প্রথম প্রতিশোধ নিবো আমি। না খেয়ে খেয়ে দেখো কী হাল করি নিজের।
রুবিনা অদূরে তানভীরকে খেয়াল করে চাঁপা স্বরে মেয়েকে বলল
– আমার ধারনা তুমি ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তোমার পাপা স্বপরিবারে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবেন। তোমাকে বিদেশ বিভূঁইয়ে একা দিয়ে মনে হয় না ছ’মাসও তিনি এদেশে টিকতে পারবেন। অবশ্য তোমার সাথেই রওয়ানা হলে, আমি একদম অবাক হব না।
অরুর নিজেরও তাই ধারণা। সে মায়ের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল।
এর দু’দিন পর অরুদের বাড়িতে দু’জন লোক এলো। লোক বলাও হয়তো ঠিক হলো না, ওদের বয়স আর কত হবে, একজনার পঁচিশ, ছাব্বিশ। অন্যজনার ত্রিশের মত। পোশাক আশাক নিন্ম পেশাজীবীদের মত। পরনে পুরানো প্যান্ট শার্ট। মাথার চুল বিবর্ণ, রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং।
বাড়িতে বাবা মা ছিলো না। ওপাশের বড় আম্মু বাইরের লোক এসেছে শুনে তাদের তরফে, নিচে একবার ঘুরে দেখে গেছেন। উপরে উঠে অরুকে দেখে বলে গেলেন
– বাইরের ঘরে দু’টো লোক এসেছে। তুমি যেন হুট করে আবার ওদের সামনে চলে যেও না। মা বাড়িতে নেই, কাজের লোকেরাই দেখাশোনা করবে।
অরু প্রশ্ন করলো
– আমি কেনো যাবো ওদের সামনে…?
– হুম, জানি যাবে না। তাও বলে গেলাম। সাবস্ট্যান্ডারড লোকজন, তুমি মিট না করাই ভালো।
– এসব বলা ঠিক না, বড় আম্মু…
তমা নিজেকে সংশোধন করে বলল
– না, এমনিই বললাম। আসল কথা হলো, তুমি নিচে যাবে না ব্যস, এটাই বলতে চেয়েছি।
বড় আম্মু চলে গেলেন।
কিন্তু কেমন অদ্ভূত কথা বলল বড় আম্মু। কে ওই ছেলেগুলো? অরুর ভীষণ কৌতূহল হলো। বাড়িতে তাদের অংশে দুটো কাজের লোক ছাড়া কেউ নেই এই মুহূর্তে। অরুর ইচ্ছে হলো টুপ করে একবার নিচে গিয়ে ওদের দূর থেকে একটুখানি দেখে আসতে। কিন্তু বড় আম্মুর নিষেধ উপেক্ষা করে কাজটা করা কী ঠিক হবে?
ছেলে দুটি বসেছিলো বাইরের ছাউনিমত জায়গাটায়। এখানে বসার ব্যবস্থা আছে। নিশ্চই বসার ঘরে নিয়ে বসানোর উপযুক্ত ভাবা হয়নি তাদের। ছেলেদুটি বসে আছে খুব কাচুমাচু হয়ে। তাদের মুখগুলো শুকনো। অরু এদেরকে আর যাই হোক কোনো ক্ষতিকর মানুষ ভাবতে পারলো না। হতে পারে অচেনা লোক তাই হয়তো বড় আম্মু তাকে সাবধান করেছে।
অরু ছেলেদু’টির সামনে এলো। অরুকে দেখে ওরা টপ করে উঠে দাঁড়ালো। ছেলেগুলোর শুকনো ঠৌঁটে এখন হাসি, চোখে বিস্ময়। তারা অরুর দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করছে।
কম বয়সী ছেলেটা বড়টির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল
– বইন….আসছে। ভাই, আমাগো বইনে আসছে…। আমি দেইখ্যাই চিনছি…
বড়টি বলল
– চুপ কর, চুপ কর গাধা।
অরু লক্ষ্য করলো ছেলে দুটোর চোখ চিকচিক করছে। তারা সলজ্জ হেসে নিজেদের চোখ মুছছে। অরু কৌতূহলী তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস না করে পারলো না,
– আপনারা কারা?
বড় ছেলেটা অস্ফুট গলায় বলল
– বইন, আমার নাম আবু, অয় আমার ছুডো ভাই বাবু। আমরা দুই ভাই।
– আপনারা আমাদের কে হন?
দু’ ভাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হলো। তারা বসলো এবং অন্যদিকে তাকিয়ে বলল
– আমরা আফনার কেউ হই না বইন। আমরা আফনার আম্মার সাথে দেখা করতে আসছি। জরুরী প্রয়োজন।
অরু কিছুক্ষণ ছেলে দু’টিকে দেখলো, তারপর চিন্তিত মুখে ভেতরে চলে গেলো। দুপুর গড়িয়ে গেলে রুবিনা বাড়ি এলো। ছেলে দুটিকে দেখে তার কপালে ভাঁজ পড়লো। পরিচয় পেয়ে গলাটাও শুকিয়ে কাঠ।
(চলবে)