আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুখসানা পারভীনের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা এবং দুর্নীতি-অনিয়মের নানা অভিযোগ তুলে চাকরি থেকে বরখাস্তের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। লাগাতার আন্দোলনের মুখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) রুখসানা পারভীনকে লালমনিরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলির আদেশ দিয়েছে। তবে মাউশির এমন আদেশকে ‘পুরস্কার’ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
রবিবার (২৫ আগস্ট) অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর সৈয়দ জাফর আলী স্বাক্ষরিত আদেশে রুখসানা পারভীনকে তার শ্বশুরালয় জেলা লালমনিরহাটে বদলির নির্দেশ দেয় মাউশি। অভিযোগের তদন্ত কিংবা বিভাগীয় ব্যবস্থা না নিয়ে নিজ বাসস্থানের কাছে বদলির আদেশ ওই প্রধান শিক্ষককে পুরস্কার করার শামিল বলে দাবি করছেন আন্দোলনরতরা।
প্রধান শিক্ষককে লালমনিরহাটে বদলির খবরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। রবিবার বিকালে তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করে স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সেনাবাহিনীর অফিসার ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করেন তারা। জেলা প্রশাসক তাদের দাবি পুনর্বিবেচনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর আশ্বাস দেন। এরপর অবরোধ তুলে নিলেও দাবি আদায়ে মঙ্গলবার থেকে আবারও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
প্রধান শিক্ষক রুখসানা পারভীনের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ উঠলেও কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না মাউশি? তার খুঁটির জোর কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনুসন্ধান করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাউশির পরিচালক প্রফেসর সৈয়দ জাফর আলীর সঙ্গে প্রধান শিক্ষক রুখসানা পারভীনের দীর্ঘদিনের সখ্যতা। তারা পাশাপাশি জেলার বাসিন্দা ও নিকটাত্মীয়। রুখসানা পারভীন পরিচালক সৈয়দ জাফর আলীকে ‘জাফর ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। এই ‘জাফর ভাইয়ের’ প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতি করে গেছেন। সর্বশেষ লালমনিরহাটে বদলির আদেশ ‘জাফর ভাইয়ের’ বদৌলতে হয়েছে।
স্কুলের সহকারী শিক্ষকরা বলছেন, প্রধান শিক্ষক রুখসানা পারভীন সবসময় তার ওই ‘জাফর ভাইয়ের’ ভয় দেখিয়ে শিক্ষকদের দাবিয়ে রাখতেন। কোনও শিক্ষক তার অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে ‘জাফর ভাইকে’ দিয়ে বদলির হুমকি দিতেন। চাকরির ক্ষতির ভয় দেখাতেন।
একে তো তিনি গোপালগঞ্জ জেলার মানুষ, তার ওপর পরিচালক সম্পর্কে তার ভাই। মূলত এগুলোই তার খুঁটির জোর। সেই জোরেই তিনি সুবিধামতো নিজের বদলি আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘তিনি পরিচালক জাফর সাহেবের ছবি দেখিয়ে বলতেন, উনি আমার ভাই। বাড়াবাড়ি করলে বদলি করাবো।’
মাউশির একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রামে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়টি জেলা প্রশাসন শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানায়।
রবিবার মাউশির সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এবিএম রেজাউল করিম প্রধান শিক্ষক রুখসানা পারভীনকে বদলির নির্দেশ দেন। নির্দেশনার নথির ফুটনোটে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সমূহের তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলেও মতামত দেওয়া হয়। কিন্তু মাউশির পরিচালক সৈয়দ জাফর আলী তা উপেক্ষা করে শুধু বদলির আদেশ দেন।
মাউশির সূত্রটি জানায়, বর্তমান পরিচালক (মাধ্যমিক) সৈয়দ জাফর আলী বিগত ১৫ বছর ধরে মাউশির বিভিন্ন শাখায় দায়িত্ব পালন করছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একজন প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে মাউশির গুরত্বপূর্ণ পদে সুবিধা নিয়েছেন। তার সঙ্গে সখ্যতার সূত্র ধরে রুখসানা পারভীন ১৫ বছর ধরে একই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বেপরোয়াভাবে স্কুল পরিচালনা করেছেন।
পরিচালকের সঙ্গে সম্পর্কের প্রভাব খাটিয়ে দাপট দেখানো, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে রুখসানা পারভীনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। তবে এর আগে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।
রুখসানা পারভীনকে নানা সুবিধা দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশি পরিচালক সৈয়দ জাফর আলী বলেন, ‘রুখসানা পারভীনের সঙ্গে আমার কোনও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পর্ক নেই। তিনি এমনটা কেন বলেছেন, তা আমি জানি না। তিনি যাই বলুন সেগুলো তার ব্যক্তিগত বিষয়।’
প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকার পরও নিজ বাসস্থান লালমনিরহাটে বদলি প্রসঙ্গে মাউশির পরিচালক বলেন, ‘নীতিমালা অনুযায়ী এখন বদলির সময় নয়। সচিব মহোদয়ের নির্দেশে তাকে নিকটবর্তী জেলায় বদলি করা হয়েছে। আবারও নির্দেশনা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের ফুটনোট দেওয়া থাকলেও ব্যবস্থা না নেওয়া প্রশ্নে মাউশির পরিচালক (ম্যাধমিক) বলেন, ‘তদন্ত কমিটি হবে। অভিযোগের তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
(ছবি: প্রধান শিক্ষিকা রুখসানা পারভীন ও মাউশি পরিচালক সৈয়দ জাফর আলী)