এম সফিকুল ইসলাম , চরফ্যাশন (ভোলা) : দ্বীপজেলা ভোলার চরফ্যাশনে বিডিএস (বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে) জরিপের কারসাজিতে প্রায় ২শ একর সরকারি খাসজমি ভূমিদস্যুদের মালিকানায় রেকর্ড দেয়া হয়েছে। বিধিবহির্ভূতভাবে এসব রেকর্ড নিয়ে সরকারি জমির মালিকানার দাবিদার ভূমিদস্যুরা সরকারি খাল এবং হালট দখলের উৎসবে মেতেছে। পাশাপাশি সরকারি খাসজমিতে বংশপরম্পরা বসতিগড়ে থাকা দরিদ্র মানুষগুলো শতবছরের পিতৃপুরুষের ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হুমকিতে পড়েছেন। ডিজিটাল জরিপের কারসাজিতে জরিপকর্মীরা অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে এভাবে সরকারি জমি ভূমিদস্যুদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যার প্রভাবে সরকার যেমন ভূমির মালিকানা হারিয়েছে, তেমনি দরিদ্র মানুষগুলোও ভিটেবাড়ি হারাচ্ছে। একইভাবে জরিমকর্মীরা বিভিন্ন মৌজায় রেকর্ডীয় মালিকদের জমিও ভূমিদস্যুদের নামে রেকর্ড দিয়ে গ্রামে গ্রামে হামলা মামলার সূত্র সৃষ্টি করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চর আইচা মৌজার সরকারি খাসজমির পরিমাণ ৭০৯ দশমিক ২৫ একর। এই মৌজার আবদুর রব প্যাদা ও মো. আলী প্যাদার নামে ডিপি ৭৫১ খতিয়ানের ৮৩২৬ দাগের ১৮ শতাংশ, আবদুর রব মিয়ার নামে ৭৫৬ খতিয়ানের ৭৪৭৩ দাগের ১৭ শতাংশ, ডিপি ৭৬০ খতিয়ানের ৭১২১ দাগের ২ একর ৪৮ শতাংশ, আলী আহমদ মিয়ার নামে ডিপি ১২০৪ খতিয়ানের ৭১১৭ দাগের ২ একর ৩৩ শতাংশ, হাজী নুরুল ইসলামের নামে ডিপি ৫৬০৭ খতিয়ানের ৭২৯০ দাগের ২৩ শতাংশ, মমতাজ বেগমের নামে ডিপি ২৮৮৭ খতিয়ানের ৭২৯৬ দাগের ৩৭ শতাংশ সরকারি খাসজমি রেকর্ড দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ চর আইচা মৌজার ৮৪৮ দশমিক ০১ একর এবং জাহানপুর মৌজার ৯১৮ দশমিক ৮৭ একর সরকারি খাসজমির বেশিরভাগ অংশ ইতোমধ্যে ভূমিদস্যুদের অনুকূলে রেকর্ড দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জরিপ বিভাগের মাঠপর্যায় কর্মরত সার্ভেয়ারদের কারসাজিতে ভূমিদস্যুরা উপজেলার বিভিন্ন মৌজার সরকারি হালট, খাল এবং দরিদ্র ভূমিহীন পরিবারের বাড়িঘরসহ দখলে থাকা খাসজমি রেকর্ড নিয়ে জবর দখলে প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এতে সরকারি হালট ও খালগুলো যেমন বিলুপ্ত হচ্ছে, তেমনি দরিদ্র ভূমিহীন পরিবারগুলো দীর্ঘদিনের বসতি হারানোর ঝুঁকিতে পরেছে। খাসজমি ভূমিদস্যুদের নামে রেকর্ড হওয়ায় এসব জমির দখল এবং বেদখল প্রশ্নে গ্রামে গ্রামে রেকর্ডীয় মালিক এবং দখলদার ভূমিহীন পরিবারগুলোর মধ্যে নতুন করে সংঘাত ও সহিংতার জন্ম হয়েছে। বাড়ছে হামলা-মামলার ঘটনাও।
দক্ষিণ নাংলাপাতা মৌজার ডিপি ৭৯৪ খতিয়ানের বিএস ৫২৯০ দাগের দশমিক ০২ শতাংশ খাসজমি রফিকুল ইসলাম ও আজিজুল হকের নামে, ডিপি ৭৩২ খতিয়ানের বিএস ৫৩৬৮ দাগের দশমিক ০৪ শতাংশ খাসজমি জামাল কামাল আলাউদ্দিন, জহির উদ্দিন রফিকুল ইসলাম ও হেলাল উদ্দিনের নামে, ডিপি ৭৯৩ খতিয়ানের বিএস ৫৩২১ দাগের দশমিক ০৫ শতাংশ জমি কামাল ফরাজির নামে, ডিপি ৭৫৪ খতিয়ানের বিএস ৫৩২৭ দাগের দশমিক ০২ শতাংশ খাসজমি মো. মোস্তফার নামে ডিপি ১১৮ খতিয়ানের বিএস ৫৩০৩ দাগের দশমিক ০২ শতাংশ খাসজমি আবদুল খালেকের নামে ডিপি ৯১৪ খতিয়ানের বিএস ৫৩২২ দাগের দশমিক ০৪ শতাংশ জমি সেরাজল হকের নামে, ডিপি ১৩১৭ খতিয়ানের বিএস ৫৩২২ দাগের দশমিক ০২ শতাংশ জমি আলতাফ হোসেনের নামে এবং ডিপি ৪৮৫ খতিয়ানের বিএস ৫৩২৬ দাগের দশমিক ০২ শতাংশ জমি জাহাঙ্গীর আলমের নামে রেকর্ড দেয়া হয়েছে। নাংলাপাতা মৌজার এসব জমি স্থানীয় আনজুর হাট বাজারে অবস্থিত এবং বর্তমান বাজারে এসব জমির দাম কোটি টাকারও বেশি। জরিপ কর্মীরা প্রভাবশালীদের সাথে যোগসাজশে কোটি টাকার সরকারি খাসজমি ব্যক্তির নামে রেকর্ড দিয়েছেন।
দক্ষিণ আইচা মৌজার মো. জুলফিকার আলী অভিযোগ করেন, এসএ ১৩১ ও দিয়ারা ১২৩ খতিয়ানের ১০০৫-১০০৭ দাগের ১ একর ২৮ শতাংশ জমির দলিল ও রেকর্ডসূত্রে মালিক তারা। সার্ভেয়ার নজরুল ইসলাম এই জমি থেকে ৩০ শতাংশ জমি প্রভাবশালী জহিরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী নুরুন নাহারকে রেকর্ড দেন। এই রেকর্ড সংশোধনের কথা বলে সার্ভেয়ার নজরুল ইসলাম, মাহাবুবুর রহমান ও মো. আকাশ, সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার আবু তাহের ও বরকত উল্লাহ তার (জুলফিকার) আলীর কাছে ১ লাখ টাকা দাবি করেন। দাবি অনুযায়ী জমির প্রকৃত মালিক জুলফিকার আলী রেকর্ড ফিরে পেতে সার্ভেয়ার নজরুল ইসলাম ও মো. আকাশকে ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। এই টাকা নেয়ার পরও রেকর্ড সংশোধন না করায় জুলফিকার আলী ও তার ওয়ারিশরা চর মানিকা অস্থায়ী জরিপ অফিসে গিয়ে কারণ জানতে চান। এসময় সার্ভেয়ার ও তার সহকর্মীরা জুলফিকার আলী গংদের মারধর করেন।
চর আইচা মৌজার মুজাম্মেল হক অভিযোগ করেন, ১৯৮৯ সনে এই মৌজার এসএ ৪৮৪ এবং দিয়ারা ৩৬২১ খতিয়ানের দেড় একর জমি বন্দোবস্ত নেন। দিয়ারা জরিপে ওই জমি তার নামে রেকর্ড করা হয়। কিন্তু বিএস জরিপে ওই জমি জনৈক আব্বাস উদ্দিনকে রেকর্ড দেয়া হয়েছে। একইভাবে করিম সরদারের জমি রমিজউদ্দিনকে রেকর্ড দেয়া হয়েছে। কবুলিয়ত দলিল, এসএ ও দিয়ারা খতিয়ান, জমির দখল সব ঠিক থাকার পরও বিএস জরিপে করিম সরদারের জমি রমিজ উদ্দিনকে রেকর্ড দেয়া হয়েছে। এভাবে আব্বাস উদ্দিন, করিম সরদার আর মুজাম্মেল হক ও রমিজ উদ্দিনের মতো অসংখ্য পরিবার এখন জমির দখল প্রশ্নে হামলা-মামলায় জড়িয়ে পরেছেন। চরফ্যাশনের গ্রামে গ্রামে এমন অসংখ্য মুজাম্মেল-করিম সরদার আর আব্বাস-রমিজদের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে জরিপকর্মীরা। মাঝ থেকে জরিপকর্মীরা বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
অর্থ লেনদেনের বিষয় সঠিক নয় বলে জরিপ কাজে কর্মরত সার্ভেয়ার নজরুল ইসলাম জানান, ভুলবশত কিছু খাস জমি রের্কড হতে পারে। ভূমি অফিসের আপত্তি পেলে ওই রেকর্ড সংশোধন করে দেয়া হবে।
সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সরকারি খাসজমি রেকর্ড দেয়ার কোন বৈধতা জরিপ বিভাগের নাই। যদি কোনো সার্ভেয়ার এমন অপকর্ম করে থাকে সে দায় তারা বহন করবে। তবে রেকর্ডগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবু আবদুল্লাহ জানান, জরিপ কর্মকর্তারা সরকারি খাসজমি ব্যক্তির নামে রেকর্ড দিলে সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখে ৩০ ধারায় আপত্তি ও ৩১ ধারায় আপিল করবো।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল নোমান জানান, খাস