সভ্য সমাজে নিঃশর্ত প্রাপ্তি বলে কিছু নেই। প্রাপ্তির পেছনে শর্ত থাকে; অধিকারের পেছনে দায়িত্ব থাকে। কিন্তু যদি এর উল্টো হয়! নিঃশর্ত প্রাপ্তি যদি ঘটে যায়, তাহলে কী হতে পারে? কারও কারও জন্য যদিও দৃশ্যত একদম কিছু না-ও হতে পারে। একেবারেই নীরবে চলে যেতে পারে সেই প্রাপ্তি। কিন্তু সবার তেমন ভাগ্যটি না-ও হতে পারে। শর্তহীন প্রাপ্তির লোভে তারা যেন নিয়ম ভাঙার যুদ্ধে অবতীর্ণ। পড়াশোনা খারাপ করলে তার ফল অকৃতকার্য- তা যেন তারা মানতে নারাজ। যেখানে ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি চলে; শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে দলাদলি চলে; সমস্যাগুলোর প্রকৃতি তেমন পাল্টায় না সেখানে। ফেল করলে পাস করিয়ে দেওয়ার দাবি; অমানবিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষকদের আটকে রাখা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন অমান্য করা; পড়ূয়াদের বিপক্ষে দাঁড়ানো; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজনীতি; ব্যবসা পরিচালনায় অযাচিত হস্তক্ষেপ- এসবই যেন এখানকার নিয়ম।
কতিপয় ছাত্রছাত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে সমাজের দৈনন্দিন সংসার চত্বরে প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যেই নিয়মভাঙা এই ব্ল্যাকমেইলের হাতেখড়ি গ্রহণ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে তারা সুযোগমতো তার প্রয়োগ ঘটায়। আর তাকে মদদ দেয় রাজনৈতিক তোষণ। কখনও কি খেয়াল করেছেন- বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বাড়িতে যা চায়, আজকের সমাজে বাবা-মা তাঁদের সবকিছু দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত চেষ্টা করেন। মোটরবাইক চালানো শেখার আগেই ছেলের দাবি ওঠে, ওটা তাকে কিনে দিতে হবে। বাবা-মা সাত-পাঁচ না ভেবেই কিনে দেন ছেলেকে মোটরবাইক। ছেলে শুধু মোটরবাইকই পাচ্ছে না; শিখে যাচ্ছে ব্ল্যাকমেইল করার জাদুমন্ত্র। ভারতের কোনো এক ধনী লোকের মেয়ের একটি গল্প ছিল। মেয়ের ২৮তম জন্মদিনে বাবা তাকে একটি উড়োজাহাজ উপহার দিয়েছিলেন। মেয়েকে ঘিরে ধরেছিলেন সাংবাদিকরা। অনুভূতি কী আপনার? মেয়েটি একটু থেমে বলেছিল- একেবারেই হৃদয় থেকে বলছি, আমার ৮ বছর বয়সে বাবা তাঁর সে সময়ের দরিদ্রতার মাঝেও আমাকে একটি ব্যাটারিচালিত খেলনা উড়োজাহাজ দিয়েছিলেন। আজ দিয়েছেন আসল একটি উড়োজাহাজ। কিন্তু সেদিনের সেই খেলনা উড়োজাহাজ আমাকে যে আনন্দ দিয়েছিল, আজ প্রকৃত উড়োজাহাজ পেয়েও যেন তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছি। সেই কষ্টে পাওয়া, বাবার কষ্টের সম্পদ দিয়ে কেনা খেলনাটি আমাকে যেন আরও বেশি আনন্দ দিয়েছিল। আজ অনায়াসে পাওয়া উপহারটি আনন্দ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছে, এটা তো আমার বাবার জন্য খুব সহজ একটি কাজ। যা অনায়াসে পাওয়া যায়, এর প্রতি যেন একটু কম আনন্দই থাকে।
একটি নামিদামি স্কুলে দু’জন ছাত্র পড়ে। একজনের বাবা ধনী, কিন্তু সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। ছেলের মন ভালো রাখতে নতুন নতুন উপহার দিয়ে তার ঘর সাজিয়ে রাখেন। তা দেখে সহপাঠী তার গরিব বাবার কাছে বায়না ধরে- তারও ওসব চাই। বাবা-মা বাধ্য হয়ে কিনে দেন। তারা ভয় পান- না পেলে ছেলে অখুশি হবে, অশান্তি করবে। এমনকি যে কোনো অঘটনও ঘটাতে পারে। এভাবেই ব্ল্যাকমেইল করার সাহস সঞ্চার হয় ওদের। কিন্তু এমনটা কি সম্ভব ছিল ওই ছেলের বাবার কিশোর বয়সে? তখন তার বাবা-মা ঠিক এভাবে যা চাইত, তা দিয়ে দিতেন কি? না, তখন চাইলেই পাব- ঠিক তেমনটি হতো না। জীবনদর্শনের পরিবর্তন হয়েছে। কীভাবে ব্ল্যাকমেইল করে পাওয়া যাবে, সেই শিক্ষাটা আজকের সমাজের ছেলেমেয়েরা শিখে নিয়েছে। সমাজ তাদের সেই সুযোগটা করে দিয়েছে। ব্ল্যাকমেইল করাটা বর্তমানে একটি বড় ধরনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই শিক্ষাটার হাতেখড়ি হচ্ছে পরিবারে এবং সেখান থেকে বড় পরিসর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আরও ব্যাপক হারে তার চর্চা হচ্ছে। শুরু হচ্ছে তার আক্রমণাত্মক আচরণ; অভিভাবকসম শিক্ষকদের ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের অমানবিক জীবনদর্শনের নতুন চর্চা।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এসবের সুযোগ বেশি। কেননা, সেখানে রাজনীতি আছে, আবার কর্মকর্তাদের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণেরও ভয় নেই। সবাই জানে- দোষী প্রমাণিত হলেও সেখানে শাস্তি দেওয়া যাবে না। কেননা, সেটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারও এসব দেখে চুপ করে থাকে। কারণ সংগঠিত নৈরাজ্যকে তারা ভয় পায়। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থাটা একটু ভিন্ন। সেখানে দোষী সাব্যস্ত হলে আর পড়তে যাওয়া যাবে না- এমনটা বিশ্বাস আছে সবার। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা, রাজনৈতিক দলের ছাত্রছাত্রীরাই তো তাদের আশা-ভরসা ও ভবিষ্যৎ। তাদের তো নাড়া দেওয়া যায় না। সেখানে শিক্ষকরা আত্মরক্ষা করতে উদ্যত হলে তা হয়ে দাঁড়ায় শোষণ। শিক্ষকদের গায়ে হাত পড়লে পুলিশও এগিয়ে আসে না। দূরে দাঁড়িয়েই তাদের মজা দেখতে হয়। কেননা, তেমনটা করতেই তাদের বাধ্য করা হয়। এটাই আজকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য।
ওই যে বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু হয়েছিল ব্ল্যাকমেইল; আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র সব যেন ওই ক্ষমতাবান শব্দটির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের নৈরাজ্য সহ্য করে ঘরের ভেতর মুখ লুকিয়ে বসে থাকলে শিক্ষকরা অপমানিত-লাঞ্ছিত হতেই থাকবেন। শুধু শিক্ষকদের নয়; সমাজের সর্বস্তরের মেরুদণ্ডই ক্রমশ মাটিতে মিশে যাচ্ছে। হুঁশ নেই যেন কারও। মিথ্যা সান্ত্বনার বাণী- ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।’ শিক্ষকদেরই মেরুদণ্ডের খবর নেই, তাঁরা জাতির কী করবেন! আর কেউ না বুঝলেও শিক্ষকদেরই আপন অবস্থানটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
সুধীর সাহা: কলাম লেখক
ceo@ilcb.net