দেশের পুঁজিবাজারে ভালো শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তুলনামূলক কম দেখা যায়। বিপরীতে মন্দ শেয়ারের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তাদের। বিনিয়োগকারীদের এ মনস্তত্ত্ব পোয়াবারো হয়েছে কারসাজিকারীদের জন্য। বাজারে গুজব ছড়িয়ে মন্দ শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।
পরিসংখ্যান বলছে, গত আট বছরে বাজার মূলধনে আধিপত্য বিস্তারকারী কোম্পানিগুলোর তুলনায় মন্দ কোম্পানির শেয়ারে বেশি রিটার্ন এসেছে। এতে বিনিয়োগকারীরাও হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন এসব শেয়ার কেনার জন্য। স্বল্প মূলধনী এসব মন্দ কোম্পানির শেয়ারে অস্বাভাবিক রিটার্নের গল্প বিনিয়োগকারীদের কাছেও বেশ উপজীব্য। এমনকি সময়মতো এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করতে না পারায় মারাত্মক হতাশায় ভুগতে দেখা গিয়েছে অনেক বিনিয়োগকারীকে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য-উপাত্ত বলছে, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এক্সচেঞ্জটির বাজার মূলধন ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। আট বছরের মাথায় গত ডিসেম্বরে তা ২ লাখ ৯৩ হাজার ১৫৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এ সময়ে এক্সচেঞ্জটির বাজার মূলধন বেড়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। আর এ বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে ৭০ দশমিক ৭ শতাংশ অবদান ছিল নয় কোম্পানির। কোম্পানিগুলো হলো ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশ লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, রেনাটা লিমিটেড, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড (বিএটিবিসি), ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও গ্রামীণফোন লিমিটেড। এমনকি গত ছয় মাসের বাজার মূলধন বৃদ্ধিতেও কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের রিটার্ন এসেছে ভালো।
গত আট বছরে এ নয় কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি রিটার্ন দিয়েছে ম্যারিকো বাংলাদেশ। এ সময় বার্ষিক গড়ে ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ হারে রিটার্ন এসেছে। এরপর সবচেয়ে বেশি ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ রিটার্ন এসেছে রেকিট বেনকিজারের শেয়ারে।
অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে কোম্পানিগুলোর রিটার্নের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ সময়ে স্বল্প মূলধনী কোম্পানি প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে ২ হাজার ৭৮ শতাংশ রিটার্ন এসেছে। স্বল্প মূলধনী ইনটেক লিমিটেডের শেয়ারেও এ সময় ৩৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ রিটার্ন এসেছে। বছরভিত্তিক রিটার্ন হিসাব করলে দেখা যায়, প্যারামাউন্টের শেয়ারে ৪১৫ দশমিক ৬ ও ইনটেকের শেয়ারে ৬৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ রিটার্ন এসেছে। এসব স্বল্প মূলধনী কোম্পানির শেয়ারে অস্বাভাবিক রিটার্নের কারণেই বিনিয়োগকারীরা এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হন বেশি। এতে আড়ালে থেকে যায় ভালো ও মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ার। বাজারের এ অস্বাভাবিক প্রবণতার কারণে অনেক ভালো কোম্পানিই তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হয় না। এতে কাঙ্ক্ষিত হারে বিদেশী বিনিয়োগও আকৃষ্ট করতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজার।
মুম্বাইভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশের গত আট বছরে বাজার মূলধন বেড়েছে ৪৬১ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ডিএসইর বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে কোম্পানিটির অবদান ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশের গত আট বছরে বাজার মূলধন বেড়েছে ৪৬১ দশমিক ৯ শতাংশ। ডিএসইর বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে কোম্পানিটির অবদান ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
বহুজাতিক রঙ উৎপাদক বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের শেয়ারে গত আট বছরে গড়ে বার্ষিক ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ হারে রিটার্ন পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ সময়ে কোম্পানির বাজার মূলধন বেড়েছে ৪৩৯ দশমিক ১ শতাংশ। ডিএসইর বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে বার্জারের অবদান ছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উদ্যোগে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার শীর্ষক রোড শোতে এক অনুষ্ঠানে দেশের পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানিগুলোর আকর্ষণীয় রিটার্নের তথ্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরা হয়। এতে উল্লিখিত কোম্পানিগুলোকে নিয়েও আলোচনা হয়।
এ বিষয়ে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, পুঁজিবাজারে একেক সময় একেক কোম্পানি ও খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তৈরি হয়। এর সঙ্গে সংগতি রেখেই সেগুলোর দর ওঠানামা করে। কোম্পানিগুলো অধিকাংশই বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানি। এসব কোম্পানির কোনো কোনোটির দুই-তিনশ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা রয়েছে। এসব কোম্পানি সুশাসন, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, ব্যবসায়িক কৌশল সবদিক থেকেই এগিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই এদের ব্যবসায়িক ও আর্থিক পারফরম্যান্সেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। এ কারণেই আমরা সবসময় দেশে বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করি। এ ধরনের ভালো বহুজাতিক কোম্পানি পুঁজিবাজারে আরো বেশি আসুক, সেটিই আমরা চাই। এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা যত বেশি হবে, সেটি আমাদের পুঁজিবাজারকে তত বেশি সমৃদ্ধ করবে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোকে অনুসরণ করে আমাদের স্থানীয় কোম্পানিগুলোও সমৃদ্ধ হতে পারবে।
দেশের ওষুধ খাতের অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি রেনাটা লিমিটেডের শেয়ারে গত আট বছরে বার্ষিক গড়ে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ হারে রিটার্ন এসেছে। এ সময়ে কোম্পানিটির বাজার মূলধন বেড়েছে ৪১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। একই সঙ্গে ডিএসইর বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে কোম্পানিটির অবদান ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
তামাক খাতের বহুজাতিক জায়ান্ট বিএটিবিসির শেয়ারে এ সময় বার্ষিক ২২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে রিটার্ন এসেছে। এ সময়ে কোম্পানিটির বাজার মূলধন বেড়েছে ৩২২ শতাংশ। আর ডিএসইর বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে কোম্পানিটির অবদান ছিল ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগের বিপরীতে আট বছরে বার্ষিক ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ হারে রিটার্ন পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ সময়ে কোম্পানির বাজার মূলধন বেড়েছে ৩৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সঙ্গে ডিএসইর বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে কোম্পানিটির অবদান ছিল ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট ও ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ছায়েদুর রহমান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ব্র্যাক ব্যাংক বাদে বাকি আট কোম্পানিই কিন্তু একচেটিয়া ব্যবসা করছে। এ কারণে এদের আয়ও বেশ ভালো। ফলে এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগের বিপরীতে আকর্ষণীয় রিটার্ন আসাটাই স্বাভাবিক। কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক ও আর্থিক পারফরম্যান্সের সঙ্গে এগুলোর শেয়ারদরও যৌক্তিক অবস্থানে থাকে। ফলে এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও তুলনামূলক কম ঝুঁকি থাকে। এগুলো সবই ব্লু-চিপ কোম্পানি। আমরা কিন্তু বিনিয়োগকারীদের বরাবরই এ ধরনের ভালো কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের জন্য পরামর্শ দিই।
বহুজাতিক ইলেকট্রনিকস উৎপাদক সিঙ্গার বাংলাদেশের শেয়ারে গত আট বছর বার্ষিক গড়ে ১৮ শতাংশ হারে রিটার্ন এসেছে। এ সময়ে কোম্পানির বাজার মূলধন বেড়েছে ১৭১ দশমিক ৭ শতাংশ। আর ডিএসইর বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে কোম্পানিটির অবদান ছিল ১ শতাংশ।
দেশের ওষুধ খাতের শীর্ষ কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারে এ আট বছরে ধরে বার্ষিক ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে রিটার্ন পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ সময়ে কোম্পানিটির বাজার মূলধন বেড়েছে ২১১ দশমিক ৩ শতাংশ। ডিএসইর বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে কোম্পানিটির অবদান ছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ।
দেশের শীর্ষস্থানীয় টেলিযোগাযোগ অপারেটর গ্রামীণফোনের শেয়ারে আট বছর ধরে গড়ে প্রতি বছর ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে রিটার্ন এসেছে। এ সময়ে কোম্পানির বাজার মূলধন বেড়েছে ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ। একই সময়ে ডিএসইর বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে কোম্পানিটির অবদান ছিল ২০ দশমিক ৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, কোম্পানিগুলো সংশ্লিষ্ট খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছে। এদের সুশাসন, স্বচ্ছতা, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালন দক্ষতা বেশ উঁচু মানের। এদের ব্যবসায়িক ও আর্থিক পারফরম্যান্সের গ্রাফ ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী থাকে। যদি কখনো কোনো প্রান্তিকে কিংবা কোনো বছরে এদের ব্যবসায় প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে তারা সেটি পুষিয়ে নিতে পারে। তাদের সে ধরনের সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া কোম্পানিগুলোর আয় ও মুনাফার সঙ্গে শেয়ারদর বাড়ার হারও সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে যখনই এ ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হোক না কেন, তুলনামূলক কম ঝুঁকির বিপরীতে আকর্ষণীয় রিটার্ন অবশ্যই আসবে। দীর্ঘমেয়াদে এসব শেয়ারে রিটার্নের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে তা-ই দেখা যাচ্ছে।