মানব সময় সাহিত্য :
ভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশের এমন এক উপায় যা ছাড়া বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে মানুষের জীবন যাত্রা মুহূর্তের জন্যও অচল। পৃথিবী পৃষ্ঠে যত মানুষ রয়েছে, তাদের সকলে কোন না কোন ভাষা ব্যবহার করেই চলমান জীবনের সামগ্রিক চাহিদা মিটিয়ে চলছে। প্রত্যেকটা মানুষ জন্মের পর মায়ের মুখের বুলি শুনতে শুনতে নিজেকেও তৈরি করে নেয় অন্যের নিকট নিজের ভাব প্রকাশের অনুসঙ্গ এই ভাষা ব্যবহারে। মায়ের মুখ থেকেই প্রথম আয়ত্ত করা হয় বলেই ভাব প্রকাশের এই অনুসঙ্গকে মাতৃভাষা বলা হয়। আমাদের অর্থাৎ বাঙালি জাতির প্রিয় মাতৃভাষা হল বাংলা।
সমগ্র পৃথিবীতে যে কত রকমের ভাষা রয়েছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান এখনো পর্যন্ত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। সৃষ্টির আদি থেকে মানব সভ্যতার পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটেছে নিয়মহীম নিজস্ব স্বাধীনতায়; তারই ধারাবাহিকতায় অঞ্চল ভেদে ভৌগোলিক অবস্থানের ভিম্নতা এবং সময়ের ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ ভঙ্গিতে নির্ধারিত হয়েছে মাতৃভাষা, যার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তন ধারা আজো বহমান। তবে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা কর্তৃক অনুমিত মাতৃভাষার সংখ্যা কম বেশি সাত হাজার। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এক প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক সংস্থা এস আই এল( সামার ইন্সটিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিক) এর গবেষণা ফলাফলে জানা যায় সমগ্র বিশ্বে মোট ভাষায় সংখ্যা ৬৯০৯ টি।এতগুলো ভাষার মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক; প্রায় ১.৪ বিলিয়ন চৈনিক তথা মান্দারিন ভাষা ব্যবহার করে বলে অনুৃমান করা হয়, এর পর রয়েছে স্প্যানিশ ভাষা, প্রায় ৪৬০ মিলিয়ন লোকের মুখের ভাষা হিসাবে দ্বিতীয় অবস্থানে, তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রায় ৩৭৯ মিলিয়ন লোকের মুখের ভাষা ইংরেজি। এই তথ্যানুসারে আমাদের বাংলাভাষার অবস্থানও বেশ মর্যাদায়পূর্ণ। ২৭ থেকে ৩১ কোটি লোকের মুখের ভাষা হিসাবে এই বাংলাভাষার অবস্থান শীর্ষ ১০ ভাষার মধ্যে অষ্টম স্থানে(কারো কারো মতে ষষ্ঠ অবস্থানে)
বহুল প্রচলিত ভাষার মধ্যে বিশ্বে অষ্টম বা ষষ্ঠ স্থানে থাকা আমাদের এই বাংলাভাষা গুণ বিচারে বর্তমানে প্রথম অবস্থানে আছে বলে ধরে নেওয়া যায়। কেননা পৃথিবী জুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বললে আমাদের এই বাংলাভাষা তথা বাংলাদেশের নামটাই এসে যায় প্রথমে। সেদিক থেকে আমাদের বাংলাদেশ তথা আমরা বাঙালিরা আজ খ্যাতির শীর্ষে। পুরো পৃথিবী জুড়ে বাঙালি জাতি গর্বিত জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে ইতিমধ্যে এই বাংলা ভাষার জন্যে। বিশ্ব ইতিহাসে খোদায় হয়ে গেছে বাঙালি জাতি ও বাংলাভাষার নাম।
বাংলাদেশের বাঙালি ছড়া পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ বা জাতি নেই যারা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আগ পিছ না ভেবে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছেন। কথিত বৃটিশ শাসনের শেষ হলেও পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাবাসীরা পাকিস্তানের অধীন হয়ে পড়ে। পাকিস্তান সৃষ্টির ৭ মাস পরেই ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল, গণপরিষদ ও মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তথা রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দানকালে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন যে, "পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু - অন্যকোন ভাষা নয়"। তিনি আরো বলেন, "এতে যদি কেউ বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু"। একই কথা তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনেও বললে কিছু ছাত্র না না বলে চিৎকার করতে থাকেন, যাতে জিন্নাহ সাহেবের সামনে একধরণের বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর আগেও ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অনুষ্ঠিত অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে পূর্ব পাকিস্তান কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত এতে সংশোধনী এনে বাংলাকেও পরিষদের অন্যতম ভাষা করার জোর দাবি তোলেন কারণ পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। এই যুক্তি সম্বলিত দাবী প্রধানমন্ত্রী লেয়াকত আলী খান সহ পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীনের বিরোধিতায় বাতিল হয়ে যায়। এখান থেকেই মূলত বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা ও পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সূত্রপাত। পরবর্তীতে যাহা অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও ঢাকার রাজপথে এক রক্তক্ষয়ী হৃদয়বিদারক অবস্থার রূপ নেয়। পাকিস্তানি পেটোয়া বাহিনীরা মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মিছিল রত(১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে) ছাত্র জনতার ওপর নির্মমভাবে গুলি চালায়, এতে করে সালাম, জাব্বার, বরকত, রফিক, শফিক, অহিউল্লাহ সহ প্রায় এগার জন ভাষা সৈনিক শহীদ হন। শুরু হয়ে যায় পৃথক ভাষা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গিকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের সদস্য ফরিদপুরের আদেল উদ্দিন আহমদের দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাব বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরি মধ্যে বাঙালিদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি জাগরণ ক্রমান্বয়ে তীব্রতর হতে থাকে। বাঙালি জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সারে সাত কোটি মানুষের জীবন মরণ লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭৪ সালে ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে বাংলায় ভাষণ প্রদান করে বাংলাভাষাকে নিয়ে যান খ্যাতির শীর্ষে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর UNESCO এই বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সাল থেকে UNESCO এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো এদিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব বানকি মুন এর উপস্থিতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু তনয়া, দেশনেত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালে ১৫ মার্চ ঢাকার সেগুনবাগিচায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট" নামক প্রতিষ্ঠানের।
জাতিসংঘের ৬৫ তম অধিবেশনের ৪র্থ কমিটিতে ২০১০ সালের ৩রা নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন ও গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে আমাদের এই রক্তভেজা বাংলা ভাষা বিশ্বের সকল ভাষাবাসীদের মনে একটি উজ্জ্বল স্থান দখল করে নেয় অতি অল্প সময়ে। আমাদের এই মিষ্টি মাতৃভাষা বাংলা সর্বাধিক লোক মুখের ভাষার ক্রমানুসারে ৬ষ্ট কিংবা ৮ম হলেও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সূত্রে আজ সব ভাষারই শীর্ষে।
লেখক :
প্রাবন্ধিক ও শিশু সাহিত্যিক
Editor : Md.Moslauddin (Bahar) Cell: 01919802081 Dhaka Office :: Manni Tower, Road 09,House : 1258 Mirpur Dhaka. Cell:01747430235 email : manobsomoynews@gmail.com Chattogram office :: Lusai Bhaban,( 2nd Floor) Cheragi Pahar Circle, Chattogram. Cell: 01919802081
© All rights reserved manobsomoy